শাসক দল কি দেশ ধ্বংস করে হলেও পুনরায় ক্ষমতায় যেতে চায়?

03,December 2018, Monday, 12:13


Abdul Gafur

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম  (Daily Inqilab)


একাদশ সংসদ নির্বাচন অতি সন্নিকটে। কেমন হবে এ একাদশ সংসদ নির্বাচন? গত রোববার জাতীয় দৈনিক ইনকিলাবের এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “নির্বাচন ফেয়ার না হলে দেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।” একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এ ধরনের আশঙ্কা খুবই বাস্তব আরও এই কারণে যে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের দুই প্রধান দলের অন্যতম দল বিএনপি কর্তৃক প্রকাশ্যে বর্জিত (বয়কট) হওয়ার কারণে সে নির্বাচন সম্পর্কে দেশের জনগণের অধিকাংশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে নির্বাচনের ভোট দানের জন্য নির্ধারিত সময় অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র ছিল প্রায় ফাঁকা, জনশূন্য।
অবশ্য দশম সংসদ নির্বাচনের এ দূরবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। যদি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরশাদের স্বৈরশাসন আমলের পরবর্তীকালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কিত সমঝোতা তাদের মধ্যে বজায় রাখতে পারতো তাহলে দেশের অন্যতম প্রধান দল (বিএনপি) কর্তৃক ঐ সমঝোতা লংঘনের জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারতো না এবং দেশে নির্বাচন প্রশ্নে এরকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারতো না।
সংবাদপত্রের পাঠক মহলের মনে থাকার কথা, জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন বাংলাদেশের সেনা প্রধান ছিলেন, তখন একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে সেই সামরিক ক্যুর প্রতি প্রথম সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেত্রীর এই অকল্পনীয় ভূমিকা সম্ভব হয়েছিল হয়ত এই বিবেচনায় যে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বিএনপি।
এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসনের পালা। পাশাপাশি চলতে থাকে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে অনেক দিন এসব আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে। ততদিনে এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে একটানা নেতৃত্ব দিয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নবাগতা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য দেশের সর্বত্র আপোষহীন নেত্রী হিসাবে প্রশংসিত হতে থাকেন।
এদিকে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও এক পর্যায়ে এরশাদ বিরোধী সে আন্দোলনে যোগ দেন। পরবর্তীকালে দেশ থেকে সামরিক শাসন উঠিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে একমত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা” ও বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, সেই লক্ষ্যে উভয় নেত্রী এই প্রশ্নেও একমত হন যে এই নির্বাচন হবে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতাকালে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু এ নিরপেক্ষ হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, কেউ ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে যেন কারচুপি আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষে যখন জানা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সু² কারচুপি হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর এই স্ববিরোধী অবাস্তব বক্তব্যকে গুরুত্ব না দেয়ায় স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলো এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা হলেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান মন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত: বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখে দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে এই বিধান রেখে সংবিধান সংশোধন করা হলো।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বিধানই যে গণতন্ত্রের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী হবে তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। এই ব্যবস্থাধীনে দেশে বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে দেশের দুই প্রধান দল পর পর পালাক্রমে নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশ চালনার সুযোগ লাভ করে।
দু:খের বিষয় কিছু রাজনীতিকের অতিরিক্ত ক্ষমতার ক্ষুধা এক পর্যায়ে এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও পচিয়ে ফেলে। এর পর এক পর্যায়ে আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের কালে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের পরিবর্তে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তাব পাশ করে সেই মর্মে ঘোষণা দিলে বিএনপি তার সাথে অতীত সমঝোতা লংঘনের অভিযোগ এনে সে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়।
দেশের দুই প্রধান দলের অন্যতম (বিএনপি) নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলে সে নির্বাচন বাস্তবে পরিণত হয় একটি নির্বাচনী প্রহসনে। জনগণ সে নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশের জনগণ যেখানে সাধারণত ভোটের দিনে সকল কাজ ফেলে আগে ভোটের লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত, সেখানে ভোটের নির্ধারিত সময়েও অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল প্রায় ফাঁকা, জনশূন্য। বিরোধী দল তো দূরের কথা, সরকারী দলের অনেক নেতাকর্মীও ভোট কেন্দ্র গিয়ে ভোট দেয়ার গরজ অনুভব করেননি।
তবে ভোট কেন্দ্রে একেবারে জনশূন্য ছিল তাও বলা যাবে না। বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কটের সুযোগে সরকারী দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মী ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সরকারী দলের প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে ইচ্ছামত সীলমেরে বিপুল ভোটে তাদের ‘বিজয়ী’ হওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। এভাবে ভোটারদের দৈহিক উপস্থিতি ছাড়াই শাসক দলের প্রার্থীদের “বিপুল ভোটে” নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করা হয়।
তবে পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি জনগণের কাছে ফাঁস হয়ে পড়ে। এ কারণে জনগণ এ নির্বাচনের নাম দেন ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’। বর্তমানে দেশ চালাচ্ছে যে সরকার, সে সরকার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই ফসল। তবে একটা বস্তু লক্ষ্য করার বিষয়, সরকারী নেতারা জনগণের সমর্থন তথা ভোট ছাড়াই সরকার চালাতে লজ্জা বা অসম্মান বোধ করেন না। জাতীয় সংসদে ভাষণ দানকালে এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে এক হিসাবে ভালই করেছে। সংসদে তাদের আবোল-তাবোল সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। সংসদে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যকে যারা আবোল-তাবোল বলে অবমূল্যায়ন করেন, তারা কতটা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ গণতন্ত্রে সরকার-বিরোধী বক্তব্যকেও যথাযথ গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য।
আরেকটি বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। উপরে উল্লেখিত নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতির স্বল্পতার কারণে এই নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন আখ্যা দিয়েছেন জনগণ। সেও তো যেসব আসনে ভোটের একটা মহড়া হয়েছে, সেসবের কথা। জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের অধিকাংশ ১৫৩ আসনে তো এই এরূপ মহড়ারও প্রয়োজন পড়েনি। সেসব আসনে শাসন দলের প্রার্থীদের বাইরে কোন প্রার্থী ছিলো না। সেসব আসনে অর্থাৎ জাতীয় সংসদের অধিকাংশ আসনে কোন ভোটাভুটিরই প্রয়োজনই পড়েনি। তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রার্থী না থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ইতিহাসে এক নয়া কলঙ্কজনক অধ্যায় যোগ করেছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যথেষ্ট দুর্নাম কুড়ালেও সরকারের নেতৃবৃন্দের ও নীতি নির্ধারকদের গণতন্ত্রের শিক্ষা গ্রহণের পালা এখনও পর্যাপ্ত হয়নি। সরকার একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা প্রভৃতির মারফত তাদের রাজনীতির ময়দান থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য যেভাবে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে চলেছেন, তাতে মনে হয় দেশ থেকে গণতন্ত্রকে সম্পন্ন বিদায় দিয়ে স্বৈরতন্ত্রী শাসন কায়েম করার আগে তারা তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করবে না।
গত রোববার দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় ইস্কাটন গার্ডেনে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ আয়োজিত সেমিনারের উপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বক্তাদের বক্তৃতা উদ্বৃত করে বলা হয়েছে “নির্বাচন ফেয়ার না হলে দেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।” ঐ পত্রিকার ঐ একই পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : “নৌকা জেতাতে গোপন বৈঠকের অভিযোগ।” এসব প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়, শাসকদল ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একাদশ সংসদ নির্বাচনেও পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তার অনেক লক্ষণ ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের আপত্তি সত্তে¡ও কয়েকটি আসনে ইভিএম ব্যবহারের প্রশ্নে অটল থাকা এর অন্যতম।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তিন তিন বার অবাধ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া বেগম খালেদা জিয়াকে আটক রেখে প্রধান বিরোধী দলকে দুর্বল করে দেয়া সরকারের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ বলে জনগণের বিশ্বাস। এসবের মাধ্যমে শাসক দল পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তাতে জনগণের এমন আশঙ্কার কারণ রয়েছে যে, দেশে তাদের দু:শাসন চালিয়ে যেতে দেশকে ধ্বংস করে দিতেও তারা রাজি।

লেখকের অন্যান্য কলাম